মোবাইল ইন্টারনেট, গতি কমে দাম কমে না
মোবাইল ইন্টারনেটে দুর্ভোগ আর অযাচিত অর্থব্যয় ছাড়া ভোক্তার কিছু পাওয়ার নেই। বাজে নেটওয়ার্ক, দুর্বল গতি, চড়া মূল্যের এবং ঝামেলাপূর্ণ সব প্যাকেজ- এরকম হরেক সমস্যা। কোনোটাই সমাধান হয় না। মাঝে মাঝে সরকারপক্ষ থেকে কিছু কথা শোনা যায়। ওই পর্যন্তই।
২০০৪ সাল থেকে বিদ্যমান হারে প্রতি কিলোবাইটের জন্য ২ পয়সা করে চার্জ করছে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো। পরিমাণভিত্তিক কিছু প্যাকেজ থাকলেও সেগুলো সাশ্রয়ী নয়। অথচ গত নয় বছরে দফায় দফায় ব্যান্ডউইথের দাম কমানো হয়েছে। ১৯৯৬ সালে এক এমবিপিএস ব্যান্ডউইথের দাম ছিল ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এরপর ধাপে ধাপে কমে ২০০৯ সালে ২৭ হাজার ও বর্তমানে ৪৫০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে এক এমবিপিএস ব্যান্ডউইথের দাম। তবে মোবাইল অপারেটররা কমায়নি গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবার মূল্য।
দেশের শীর্ষ মোবাইল অপারেটর কোম্পানি গ্রামীণফোনের আনলিমিটেড ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্য পূর্বে যা ছিল, এখনো তাই আছে। এছাড়াও এতে আবার শর্ত জুড়ে দেয়ার অভিযোগও আছে ব্যবহারকারীদের। আনলিমিটেড প্যাকেজের ৫ জিবি ব্যবহারের পর স্পিড আর থাকে না বললেই চলে।
বাংলাদেশের মোবাইল ইন্টারনেট সেবার প্রথম আমলে গ্রামীণফোন ‘পি১’ নামে একটি প্যাকেজ চালু করে। শুরুতে এই প্যাকেজে প্রতি কিলোবাইটের জন্য দুই পয়সা করে কাটা হতো। এরপর অনেক বছর চলে গেছে। তবে গ্রামীণফোনের ‘পি১’ প্যাকেজের সেই রেট আজও আছে, একটুও কমেনি।
২০০৬ সালে গ্রামীণফোনের এক হাজার টাকার আনলিমিটেড ব্যান্ডউইথ সংযোগটি এখন ৮৫৪ টাকা করা হলেও তা ৫ জিবিতে কমিয়ে আনা হয়েছে। আর এর গতি নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক। সবচেয়ে বেশি গ্রাহক হলেও ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২৩৬ কেবিপিএস পর্যন্ত সেবা পেয়ে থাকে জিপি মডেম ব্যবহারকারীরা।
সেলফোন অপারেটরদের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা সিটিসেল এই সেবা চালু করে ২০০৭ সালের ৩০ জানুয়ারি। তখন ২৩৬ কেবিপিএস সংযোগের ৬ জিবি’র ইন্টারনেট প্যাকেজ ব্যবহারে গ্রাহককে ব্যয় করতে হতো সাত হাজার টাকা। ২০০৫ সালে জুম আল্ট্রা প্যাকেজ দিয়ে ৫ জিবি সংযোগের মূল্য নির্ধারণ করা হয় তিন হাজার ৫০০ টাকা। এখনো এই মূল্যই বর্তমান রয়েছে। শুরুতে ১ হাজার টাকা দিয়ে ইন্টারনেট সেবা শুরু করা সেলফোন অপারেটর রবি একপর্যায়ে মাসে ৭৫০ টাকায় আনলিমিটেড ব্যবহারের একটি প্যাকেজ ছাড়ে। বর্তমানে এই প্যাকেজ ৫ জিবিতে সীমিত করে ৬৫০ টাকা করা হয়েছে।
একই অবস্থা বাংলালিংক ইন্টারনেট সংযোগের। সর্বোচ্চ ২৩৬ কেবিপিএস সংযোগমূল্য ৬৫০ টাকা। তবে এই প্যাকেজটি আনলিমিটেড। এয়ারটেলের ইন্টারনেট ট্যারিফ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২৩৬ কেবিপিএস সংযোগমূল্য ৫ জিবি ৬৫০ টাকা। অপরদিকে টেলিটক থ্রিজি ৫১২ কেবিপিএস এর মূল্য ১৫০০ টাকা এবং টুজি’র মূল্য ৬০০ টাকা।
ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে সিটিসেল ও টেলিটক ছাড়া কোনো অপারেটরের প্যাকেজেই গতির বিষয়টি উল্লেখ নেই। ফলে আপলোড বা ডাউনলোডের গতি সম্বন্ধে কোনো ধরনের ধারণা পাওয়া যায় না। আগে থেকে ব্যবহার করছেন, এমন কারও কাছ থেকে জেনে নিয়ে অথবা নিজে ব্যবহার করে এসব অপারেটরের ইন্টারনেট সেবার গতি ও মানের বিষয়ে ধারণা পেতে হয়।
স্পিডটেস্ট ডটনেট বা টেস্টমাই ডটনেট এর মতো সাইটগুলো দিয়ে মোবাইল ইন্টারনেটের গতি পরীক্ষা করা গেলেও সাধারণত অধিকাংশ মোবাইলে ইন্টারনেট প্যাকেজ এতই দুর্বল গতিসম্পন্ন যে, এসব ওয়েবসাইট মোবাইলে লোডই হয় না। এছাড়া সেলফোন অপারেটরদের দেয়া ইন্টারনেটসেবার ক্ষেত্রে ডাটা লস ছাড়াও বেশকিছু অপ্রকাশ্য ব্যয় রয়েছে। এটা গ্রাহকের কাছ থেকেই আদায় করা হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে ৩৬টি আইআইজি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আইআইজি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যান্ডউইথ নিয়ন্ত্রণ ও পাইকারি ব্যান্ডউইথ আইএসপিদের কাছে বিক্রি করে এবং আইএসপিগুলো গ্রাহক পর্যায়ে এ সেবা দিয়ে থাকে। সাধারণ হিসেবে দেখা যায়, আইএসপিগুলো সরকারের কাছ থেকে ১ এমবিপিএস ব্যান্ডউইথ সব মিলিয়ে ৫ হাজার টাকায় এক মাসের জন্য কেনে। এখানে আপ ও ডাউন উভয়ই কন্টেন্ট ধরে নেয়া। ১ এমবিপিএস অর্থাৎ ১ সেকেন্ডে ১ এমবি ডাটা। তাহলে তারা এক মাসে ঐ টাকায় যা পেল তার পরিমাণ= ৩০ x ২৪ x ৬০ x ৬০ = ২৫৯২ হাজার এমবি = ২৫৯২ জিবি ডাটা। তাহলে আইএসপির প্রতি জিবি ডাটার ক্রয়মূল্য ৫০০০/৫২৯২ = ১.৯২ টাকা প্রায়। অথচ বিক্রি করছে ৩৪৫+ভ্যাট টাকায়। প্রায় ২০০ গুণ লাভ।
কেন কমছে না মোবাইল ইন্টারনেটের মূল্য? এ প্রশ্ন করা হলে সিটিসেলের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘সিটিসেল গ্রাহকসেবাকে মাথায় রেখেই যাত্রা শুরু করেছে। একমাত্র আমরাই এখানে ভালো মানের ইন্টারনেট সেবা দেই। এ কারণেই সিটিসেল তার ইন্টারনেট সেবার জন্য আলোচিত। কিন্তু দাম চাইলেই কমানো যায় না সরকারের কারণেই। সরকার ব্যান্ডউইথ ফ্রি দিলেও পরিবহন খরচের জন্য ইউজারকে একই দাম দিতে হবে। যার জন্য লাগে তরঙ্গ, আর তরঙ্গের জন্য সরকারকে ফি দিতে হয়, প্রতি মেগাহার্জ শত শত কোটি টাকা। আসল খরচ ঐ ব্যান্ডউইথ ইউজার এন্ডে পৌঁছানোতে। পরিবহনের ৮০ ভাগ খরচ এই তরঙ্গে। সরকার ব্যান্ডউইথের মূল্য ১ লাখ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকায় নিয়ে এলেও তরঙ্গের দাম এক পয়সা কমায়নি।’
এ প্রসঙ্গে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের অনেকেই একমত প্রকাশ করেন। সফটওয়্যার নির্মাতাদের প্রতিষ্ঠান বেসিসের একজন সহসভাপতি বলেন, ‘ব্যান্ডউইথ যেন সর্বনিম্ন ব্যবহার হয় তার অসংখ্য পলিসি করেছে সরকার। আগামী মাসেই থ্রিজি নিলামে প্রতি মেগাহার্জ তরঙ্গের জন্য ১৫০ কোটি টাকা স্টার্টিং বিডিং ধরা হয়েছে। প্রত্যেক অপারেটরকে ১০ মেগাহার্জ স্পেকটার্ম নিতে হবে যার বিডিং শুরু ১৫০০ কোটি টাকা থেকে। এত টাকায় তরঙ্গ কিনে ইউজারকে যা দিতে পারবে তাতে স্বল্প আয়ের মানুষ ইন্টারনেট তো পাবেই না বরং বাংলাদেশের ডমেস্টিক ব্রডব্যান্ড বেকবোনের স্বপ্নেরও ১২টা বাজবে। আমরা বলি, থ্রিজি স্পেকটার্ম ফ্রি দিতে হবে, পরে ৪ ভাগের পরিবর্তে ১৫-২০ ভাগ প্রফিট শেয়ার করা হবে, যেন কৃষকের ছেলেও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে।’ যদিও মেগাহার্টজ তারা কিনেছে এককালীন ১৫ বছরের জন্য এবং তা দিয়ে মোবাইল কলের ব্যবসাও করছে। সেক্ষেত্রে এই যুক্তি ধোপে টিকে কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
মোবাইল ইন্টারনেটের এসব সমস্যার সঙ্গে যোগ হয় ফোন কোম্পানির স্বেচ্ছাচারিতা। কোনো সমস্যা হলে কল সেন্টার থেকে সাহায্য পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ গ্রাহকদের। অনেক কাস্টমার কেয়ার সেন্টারের নম্বরে ফোন দিলে কেউ ফোন ধরে না। কখনও যদি ফোন ধরে সঠিক তথ্য দেয় না। গ্রাহকদের প্রতি বিরক্তি দেখিয়ে ফোন কেটে দেয়া হয়। আবার দীর্ঘ সময় বসিয়ে রেখে কলটি কেটে গেছে বলে জানানো হয়। মিরপুর নিবাসী আফজাল হোসেন ফার্মগেটে একটি ডিসপেনসারিতে বসেন। তিনি জানান, ‘মাঝে মাঝে ইন্টারনেটে ঢুকে ফেসবুক চালাই নিজের মোবাইলটি দিয়েই। কিন্তু মহাবিপদে আছি। গ্রামীণের ১৫ মেগাবাইটের কানেকশন নিতে হয় ৩৩ টাকা দিয়ে। এটা এক মাসের। একেবারেই স্বল্প মাপের ইন্টারনেট ব্যবহার। এয়ারটেলে প্রতিদিন ১০ মেগাবাইট ১০ টাকায় পাওয়া গেলেও গ্রামীণে এমন কিছু নেই। এই নেটেও সমস্যা। মেয়াদের আগে শেষ হলে আবার টাকা খরচ করে মেসেজ পাঠিয়ে অ্যাক্টিভ করতে হবে। সারাক্ষণ হেন তেন মেসেজ পাঠাতেই থাকে। কোনো সমস্যা হলে ফোন করলে টাকা খরচ। তারা ফোন ধরলে বলে, স্যার সমস্যাটা সাময়িক। ঠিক হয়ে যাবে। এটা কোন সেবা?’
সবচেয়ে বেশি তোপের মুখে আছে গ্রামীণফোন ও টেলিটক। গ্রামীণের ব্যয় সবচেয়ে বেশি আর টেলিটকের সেবার মান সবচেয়ে বাজে। ইন্টারনেট সংযোগের বিষয়ে তথ্য নিতে টেলিটকের ফার্মগেটের কাস্টমার কেয়ারে থেকে ফিরে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘কল সেন্টারের ছেলেমেয়েরা সাধারণ গ্রাহকদের একপ্রকার বেকুব হিসেবে ধরে নেয়। যদি আপনি রাগান্বিত স্বরে কথা বলেন, তাহলে ধরে নেয় স্পেশাল গ্রাহক। আবার যদি আপনি কোনো টেকনিক্যাল প্রশ্ন করেন তাহলে ধরে নেয় আপনি অনেক জানেন। তখন তাদের একটাই উত্তর। বলবে, অভিযোগটি আমরা লিপিবদ্ধ করে রাখছি স্যার, ধন্যবাদ আপনার প্রশ্নের জন্য। অতি শিগগিরই এটা কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। আসলে এখানে কোনো সেবাই দেয়া হয় না।’
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাবে দেশে মোবাইল সংযোগের সংখ্যা ১০ কোটির কাছাকাছি। এর মধ্যে প্রায় তিন কোটি ডিভাইস ধারাবাহিক বা সাময়িকভাবে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত। এই বিপুলসংখ্যক ইন্টারনেট ইউজারের জন্য সরকারের কি কোনো মাথাব্যথা নেই? যেখানে এর ওপর দেশের অগ্রযাত্রার অনেক কিছু নির্ভর করছে। সরকার নিজেও ক্ষমতায় এসেছে ডিজিটাল বাংলাদেশের সেøাগান দিয়ে। এ প্রশ্নের উত্তর কারও কাছে নেই। বরং গত চার বছরের তুলনায় মেয়াদের শেষ সময়ে এসে গত মাস থেকে ইন্টারনেটের অবস্থা আরও কাহিল করে ফেলল সরকার।
সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে সরকার একটু উদ্যোগী হয়। গ্রাহকদের ‘হয়রানি বা প্রতারণা’ ঠেকাতে মোবাইল ফোন অপারেটরদের জন্য ১৪টি প্রস্তাবিত নির্দেশনা নিয়ে গ্রাহকের মতামত নেয় বিটিআরসি। পরে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারের ফি কমানোর বিষয় ছাড়া বাকি সবগুলোর ব্যাপারে নির্দেশনা জারি করে সংস্থাটি।
আট মাস আগে ইন্টারনেটের চার্জ কমানোর বিষয়ে ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে মতামত আহ্বান করেছিল বিটিআরসি। ওই মতামতে শতভাগ ব্যবহারকারী চার্জ কমানোর কথা বলেছেন।
মতামত আহ্বানের কয়েক মাস পরও বিটিআরসি ইন্টারনেটের চার্জ কমানোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়ায় আন্দোলনে নামেন ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন ফোরাম। সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন ছাড়াও ফেকবুকে চলতে থাকে ব্যাপক প্রচারণা। তার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যান্ডউইথের দাম কমানোর ঘোষণা আসে এপ্রিলে। কিন্তু সেই ঘোষণার কোনো সুফল দৃশ্যমান হয়নি। দাম কমেনি কোনো অপারেটরের ইন্টারনেট সেবার।
বরং দাম কমানোর ডামাডোলে একযোগে কিছুদিন সব ধরনের ইন্টারনেট ইউজাররা গতি নিয়ে সমস্যায় পড়েন। ওই কয়েকদিন ফেসবুকে ছবি আপলোড, স্কাইপে ভিডিও চ্যাটসহ ইন্টারনেট ব্যবহারে নানা সমস্যায় পড়েছিলেন ব্যবহারকারীরা। কোনো ওয়েবসাইটই ঠিকমতো দেখা যেত না। কারণ হিসেবে জানা যায়, দাম কমানোর ঘোষণার মধ্যেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়েগুলোকে (আইআইজি) ইন্টারনেটের সার্বিক আপলোড গতি কমাতে বলে।
আইআইজি সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্র জানায়, ১৬ মে সন্ধ্যায় কয়েকটি আইআইজিকে আইএসপির জন্য আপলোড ব্যান্ডউইথ ৯০ শতাংশ কমিয়ে মাত্র ১০ শতাংশ করার নির্দেশ দেয় বিটিআরসি। এতে যখন ইন্টারনেটসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে থাকে, তখন রাত ১১টায় এ নির্দেশনা তুলে নেয়া হয়। কিন্তু ২৫ শতাংশ পর্যন্ত আপলোড গতি সীমিত রাখার নির্দেশটি বহাল ছিল বেশ কয়েক সপ্তাহ। এখন তা ঠিক করে আনা হলেও গ্রাহকরা নানা ধরনের ভোগান্তির মুখোমুখি হচ্ছেন।
এই নির্দেশনার কারণ সম্পর্কে সরকারপক্ষের ভাষ্য ছিল, ইন্টারনেটে ‘অপশক্তির উত্থান’ এবং ‘বিকৃত তথ্য’ প্রচারে বাধা দিতেই ‘নিরাপত্তার খাতিরে’ আপলোড গতি কমানো হয়েছিল। ঠিক এ কথাগুলোই বলেছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোঃ আব্দুল ওয়াদুদ। ইন্টারনেটের এই বেহাল দশা বিশেষ করে মোবাইল গ্রাহকদের এই হাল সম্পর্কে সরকারের পরিকল্পনা কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির বর্তমান জগতে চলতে হলে ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি ও ব্যান্ডউইথের গতি বাড়াতে হবে। আমরা এই গতি বাড়ানোর সুপারিশ করেছি কমিটির পক্ষ থেকে।’
কিন্তু দাম কমলেও তো ভোক্তারা সেই সুবিধা পায় না। এ নিয়ে কি কিছু করার আছে?
‘বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমরা বসবো।’
ইন্টারনেটের উচ্চমূল্য, কম গতি ও সেবা সমস্যার সবচেয়ে বড় বলি হচ্ছেন আউটসোর্সিং শিল্পের সঙ্গে জড়িত মুক্ত পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সাররা। অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিং এর সঙ্গে যুক্ত ভিওআইপি সংক্রান্ত ব্যবসা সহযোগী আজম খান বলেন, ‘সবসময় ল্যাপটপের সামনে থাকা সম্ভব হয় না। তাই মোবাইলে আমাদের মতো সকলেরই উচ্চগতির ইন্টারনেটের প্রয়োজন পড়ে। এখন ট্যাব বা স্মার্টফোনের খাতিরে মোবাইলের মাধ্যমেই সব কাজ করা যায়। কিন্তু এটা করা যাচ্ছে না স্বল্প গতির ইন্টারনেট ও তাদের সেবা না থাকার কারণে। কোনো কাজ করতে একাধিক ফাইল খুলে অপারেশন চালাতে হয়। অধিকাংশ সময় দেখা যায় কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ পেজ খুলছে না। তখন বাধ্য হয়ে ক্ষ্যান্ত দিতে হয়। এরা শুধু টাকাই নেয়। এরকম চড়া মূল্যে দুনিয়ার কোথাও ইন্টারনেট বিক্রি হয় বলে আমাদের জানা নেই।
এ ব্যাপারে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান দ্য ওয়েবল্যাবের প্রধান নির্বাহী এনায়েত হোসেন বলেন, ‘যারা গ্রাফিক ডিজাইন, ত্রিমাত্রিক মডেলিংসহ ফাইল পাঠানোর কাজ করেন, তারা মোবাইল ইন্টারনেটের বেহালদশার কারণে তাদের সামর্থ্যরে পুরোটা দিতে পারছেন না। আউটসোর্সিং থেকে বর্তমানে বাংলাদেশের আয় ৩ কোটি ডলার। সরকারের উচিত এ খাতে প্রণোদনা দেয়া। প্রায় কোনো সহযোগিতা ছাড়াই এ খাত এতদূর উঠে এসেছে।’
তিনি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা পরিষ্কার করেন এভাবে- আমাদের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনজন দুবাইয়ের একটি হোটেলের হয়ে ২৪ ঘণ্টা অনলাইনে থেকে যে কোনো প্রশ্নের জবাব দিয়ে গ্রাহকদের সেবা দিয়ে থাকেন। এখানে কোনো ছুটি নেই। তবে দেখা যায় কোনো কোনো দিন হয়ত কোনো গ্রাহকই প্রশ্ন পাঠায় না। যদি মোবাইল ইন্টারনেট সার্ভিস ভালো হতো তাহলে একটা ছেলে তার অন্যান্য কাজের ফাঁকে যেখানেই থাকুক এ কাজটা করে ফেলতে পারত। এখন তাদের এজন্য সারাদিন বাসায় ল্যাপটপের সামনে বসে থাকতে হয়। কারণ ফোনের ইন্টারনেট সার্ভিস একেবারেই ভালো না।
বেসরকারি কয়েকটি ফোন কোম্পানির সঙ্গে এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলেও তাদের কাছ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গ্রামীণফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, এ বিষয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছাড়া আর কারো কথা বলার অনুমতি নেই। তিনি দেশের বাইরে আছেন। ফিরে এলে ই-মেইলের মাধ্যমে জানানো হবে। তবে সহজেই পাওয়া গেছে টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবুর রহমানকে। প্রশ্ন রাখা হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। সরকারি কোম্পানি হওয়ায় জনগণের ভালো খারাপের সঙ্গে আমাদেরও অবস্থা ওঠানামা করে। কর্পোরেট অন্যসব কোম্পানির মতো তো আমরা এগোতে পারি না। বাজেট ঘাটতি তো আছেই। কিছু দুর্যোগও আছে। অন্যদের চেয়ে আমাদের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা বেশি। তাই অভিযোগও একটু বেশি আসে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে ইন্টারনেটে এবং কমিউনিকেশনে কিছু সমস্যা হয়, সার্ভার প্রবলেম হয়, তখন তথ্য সরবরাহে কিছু ঘাটতি দেখা গেলেও কর্মকর্তারা সবসময়ই গ্রাহকদের সমস্যা সমাধানে তৎপর থাকেন। তবে এটা মাথায় রাখতে হবে যেহেতু আমরা রাষ্ট্রায়ত্ত তাই আমাদের বিরুদ্ধে নানা খবর ছড়াতে কাজ করে চলেছে একদল স্বার্থান্ধ গোষ্ঠী। তারাই টেলিটকের নামে অপপ্রচার চালায়। টেলিটকের মতো ইন্টারনেট সেবা আর কারো নেই।’
আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করি বিটিআরসির চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোসের সঙ্গে। টানা তিন দিন বার বার ফোন দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। বিটিআরসির সচিব মাহবুব আহমেদকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘ইন্টারনেটের দাম কমানোর বিষয়টা এক আদেশে হয় না। অনেক ধরনের কাজ আছে এখানে। আমরা ব্যান্ডউইথের দাম কমিয়েছি। মোবাইল কোম্পানিগুলো জানিয়েছে তারা প্যাকেজ সংশোধন করবে দ্রুতই। তারা কিছুদিন সময় চেয়েছে। দাম এবার কমবে।’
কতদিন লাগবে দাম কমতে?
‘শিগগিরই হয়ে যাবে। মন্ত্রণালয়, সংসদীয় কমিটি, আইআইজি, আইএসপি ও অপারেটরদের একটা বৈঠক হতে পারে এ মাসেই। সেখানেই সব চূড়ান্ত হবে।’ সূত্র: সাপ্তাহিক
Post a Comment